মেয়েটি ছেলেটির বাইক দেখে প্রেমে পড়ল অতপর
রিতু বাইকে
চড়তে অনেক ভালোবাসে । আর সেটা বুঝতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেল । শুধু ভালবাসায় না । বাইকে
চড়া রিতুর সখ আর নেশা দু’টো ই বলা যায় ।
রিতুকে অনেক
ভালোবাসি । তাইতো হাজারো রাগ ভুলে তার কাছে
ফিরে ফিরে আসি । তার সকল অভিমান ভাঙাতে প্রাণপন চেষ্টা করি । সামান্য কিছু টাকা
পায় টিউশনি করিয়ে । নিজের খরচ আর পড়াশোনার খরচ চালিয়েও যতদূর সম্ভব তার জন্য কিছু কিছু
টাকা জমায় সারাটা মাস ধরে । মামার বাসায় থাকলেও নিজের খরচ নিজে চালাতে ভালোবাসি ।
আমার রিতুকে
কিন্তু আমি এসব কথা জানতে দেয় না । কারণ আমি চাইনা সে কষ্ট পাক । রিতুর বাবা নেই ।
মামার বাসায় থাকতো । মামারা যথেষ্ট ভালো । তাকে ওনাদের নিজের মেয়ের মতো করে লালন পালন
করেন । আর সেখানে ছিল তার দাদা রতনও । কিন্তু কিছুদিন আগে তার মামাদের অমতে একটা মেয়েকে বিয়ে
করায় মামারা তকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ।
রিতুর সাথে
আমার প্রথম দেখা হয় বৃষ্টিভেজা একরাতে । বাস স্টান্ডে দাড়িয়ে ছিল । আমি চায়ের দোকানে
বসে অনেকক্ষণ ধরে তাকে খেয়াল করছিলাম । সে
দাঁড়িয়ে আছে । প্রথমে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল । চায়ের দোকানে আমি বসে আছি । বেশ ভিড় সেখানে
। আর কোন মেয়ে বা মহিলাও নেই সেখানে । খুব একটা গাড়ি চলাচল করছিল না । কয়েকটা গাড়ি
আসলেও বেশি ভাড়া চাচ্ছিল । তাই আর সে যাচ্ছিল না । এভাবে রাত দশটা বেজে গেল । বৃষ্টিটাও
অনেক বেড়ে গেল । আমিও বাড়ি যেতে পারছিলাম না । কারণ আজ আমিও ছাতা আনিনি । হাতে তার
তিনটা ব্যাগ । দুইটা ব্যাগ বেশ বড় ।
এ শহরটা আমার
কাছেও নতুন । আমি এখানে মামার বাসায় থাকি । মামা-মামি , মামাতো বোন টুনি আর আমি ।
মামি বাসা থেকে কয়েকবার ফোন করেছে । মামি আমাকে খুব ভালবাসেন । অবশেষে না পেরে মামাকে
ছাতা দিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়ে দিলেন । মামা এসেই বললেন চল বাড়ি যাই । ছাতা নিয়ে
বের হতে পারিস না । আমি বললাম মামা দেখ ওইযে মেয়েটা অনকেক্ষন দাঁড়িয়ে আছে । মনে হয়
বাড়ি থেকে কেউ নিতে আসতে পারে নি । মামা হেঁসে উঠলেন । তো কবে থেকে জনদরদি হলে ? নাকি
জতিষ -মহারাজ । মামা আমি তো এমন কিছু বলিনি । দেখ এখানে আর কোন মহিলা বা মেয়ে লোক নেই
। একা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আর একা থাকবে এতো
রাতে । এটা কেমন দেখাই না মামা । মামা আমাকে
দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গেলেন মেয়েটার দিকে । তার বাড়ি কোথায় শোনার জন্য । মামা তার কাছে গিয়ে
কিছু কথা বলল । আর কিছুক্ষণ পর দেখি বেশ হাসি আর ঠাট্টাতে মেতে উঠেছেন ।
আমিতো অবাক
। ভিজতে ভিজতে এগিয়ে গিয়ে জানতে পারলাম । উনি আমার মামা যে ফ্লাটে ভাড়া থাকেন সেখানেই
একটা ফ্লাটের রতন দাদার আত্নীয় । রতনকে দাদা
বলি কারণ উনি আমার মামার বন্ধু হলেও ওনাকে ওনার বিয়ের আগে থেকে চিনি । আর তখন আমরা
লুকিয়ে একসাথে কত ঘুরে বেড়িয়েছি । সিনেমা আর পার্কে বসে সিগারেটের টান । সব জায়গায়
উনিই আমার গুরু । তাই ওনাকে প্রথমে মামা ডাকলেও পরে রতন দাদা আমাকে বলে তুমি আর আমাকে
মামা বলবা না । দাদা বলবা । তার কিছু দিন পর দাদা ভালবেসে নিপা নামের একটা মেয়েকে বিয়ে
করে । আর তারা এখানেই ওঠেন । আগে অবশ্য এখানে থাকতেন না । রতন দাদা আর নিপা বউদিকে
সারপ্রাইজ দিতে এসে বৃষ্টিতে আটকে গেছে মেয়েটা ।
সেদিন মামা
আর আমি মিলে তার ব্যাগ গুলো নিয়ে ভিজে ভিজে বাসায় আসলাম । আর মেয়েটা ছাতা মাথায় বেশ
মজাতেই আসলো । বাসার সামনেই মামি দাঁড়িয়ে ছিল । আমাদের জন্য । সাথে একটা অপরিচিত মেয়ে
দেখে, আর তার সাথে আমদের হাতে তিনটা ব্যাগ দেখে মামি ভাবে । নিশ্চয় আমিও রতন দাদার
মত কাউকে না জানিয়ে কাজ সেরে ফেলেছি । মানে বিয়ে করে ফেলেছি । তাও মামি খুব খুশি ।
আমাদের দাঁড়াতে
বলে ভেতর থেকে প্রদীপ ফুল আরো অনেক কিছু নিয়ে আসলেন ।নতুন বউ বাড়িতে আসলে যাযা করতে
হয় । প্রায় সব করে ফেললেন । আর এদিকে আমার মামাতো বোন টুনিতো দৌড়ে এসেই মেয়েটার কোলে
উঠে গেল । আর জোরে জোরে চিৎকার করছে । আমারও বউদি মনি আছে আমারও বউদি মনি আছে । মামা
আর আমি তো লজ্জায় পড়ে গেলাম । মেয়েটাও বেশ লজ্জা পেল । আর টুনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিল
।
মামা এবার
মামিকে সব বুঝিয়ে বললেন । তারপর আমরা ভেতরে গেলাম । মামা রতন দাদাকে ফোন করে নিপা বউদিকে
নিয়ে জলদি আমাদের এখানে আসতে বললেন । এর মধ্যেই মামি আমদের জন্য কফি তৈরি করলেন । আর
আমারা ভেজা কাপড় পাল্টে এসে টিভিটা চালিয়ে গল্প করতে শুরু করলাম । এর মধ্যেই কলিং বেলটা
বেঁজে উঠল । দেখি যে দাদা আর বউদি এসেছেন । প্রথমে মেয়েটিকে দেখে কিন্তু ভালভাবে খেয়াল
করেনি হয়তো বা তাকে এখানে আশা করেনি তাই বউদি বলেন মেয়েটি কে ?
আমরা সবাই
তো হো হো করে হেঁসে উঠি । দাদা আর বউদি এবার
ভালভাবে খেয়াল করে । সে আর কেউ নয় বউদির বোন । তারপর স্ট্যান্ড থেকে এ পযর্ন্ত কি কি
ঘটেছে আবার পুনরায় মামা তাদের বলল । আর সবাই হেঁসেই খুন । আমি মেয়েটিকে বার বার দেখছিলাম
। মেয়েটিও কয়েকবার দেখেছিল আমাকে । এটা জানতে পারলাম সে এখন থেকে এখানে থেকে পড়াশোনা
করবে । এরপর থেকে আমাদের এখানে সে মাঝে মাঝে আসতো । মামা আর রতন দাদা এখন একই অফিসে
আছেন । তারা দু’জন অফিসে বেরিয়ে গেলেই বউদি আর সে আসতো । আগেও বউদি আসতো । তবে তখন
একা আসতো ।
একদিন দু’দিন
করে মেয়েটার সাথে খুব ভালো সর্ম্পক গড়ে উঠলো । আমিই ছিলাম তার একমাত্র বন্ধু এই নতুন
শহরে । মেয়েটি তখনো বেশ স্বাভাবিক ছিল । দু’মাস
পর সে ঢাকা ইউনির্ভাসিটিতে এডমিশন পেল । আর তার নতুন নতুন বন্ধু হলো । আর সে আমাকে
ভুলে যেতে থাকলো । আমরা কখনও কাউকে বলিনি যে আমরা ভালোবাসি একে অপরকে । আর এভাবে তার
বন্ধু বাড়তেই থাকল আর আমি দিন দিন তার থেকে
দূরে সরে যাচ্ছিলাম । আর এভাবে সে একদম বদলে গেল । তাকে দেখতাম তার বন্ধুদের বাইকে
বাসায় ফিরতে । মাঝে মাঝে রাতেও বের হতো ।
বউদি অবশ্য
কিছু বলতেন না । আমি মনে মনে কষ্ট পেলেও তাকে বুঝতে দিতাম না । আমি বাড়িতে আমাদের জমির
একটা অংশ বেঁচে একটা বাইক কিনব ভেবে ছিলাম । হ্যাঁ এটা রিতুকে কাছে পাবার জন্য । তারপর
একদিন সে আমকে বলবে আমাকে তোমার বাইকে একটু ভার্সিটিতে দিয়ে আসবা ? সেদিন আমার যে কি
আনন্দ হবে। এভাবে মাঝে মাঝে বের হবো আমরা । বিকালে সকালে আর দিনগুলি আবার অনেকটা আগের মতো হবে
। কিন্তু সেই সময়টা রিতু আমাকে দিল না ।
কিছুদিন পর
একদিন সকালে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম রিতুর জন্য। রিতু আসলো কিন্তু আমাকে যেন দেখতেই
পেল না । আমার সামনে দিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপাশে একটা নতুন দামি বাইকে উঠল । আমি সেদিন
অনেক কষ্ট পাই অনেক অনেক কষ্ট । আমি বুঝতে পারি রিতু এ শহরটাকে বুঝে ফেলেছে । এখানকার
মানুষকে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটাও সে ভালো আয়ত্ব করে ফেলেছে ।
তাই এখন আর
ঘর থেকে খুব একটা বের হই না । মামি বিষয়টা বুঝতে পারে আর আমাকে অনেক ভাবে সান্তনা দেন
। আমি সারা রাত কাঁদতাম । মামা আর মামি জব জানতেন কিন্তু কিছু বলতে পারতেন না । মামা
মামি অনেক আশা নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় রিতুদের ওখানে যান । আমকে আসলে সে ভালোবাসে কিনা
ব্যাপারটা জানতে । রিতু স্পষ্ট জানিয়ে দেয় আমাকে সে ভালোবাসে না । সে রিমনকে ভালোবাসে
আর ফেসবুকে রিমনের পোষ্ট করা কিছু ফটো মামা আর মামিকে দেখায় । বউদি আর দাদাও অবাক হয়ে যান । কারণ তারা এসব কিছুই জানতেন না ।
আর রিতুর আচরণ তাদের ও চিন্তায় ফেলে দেয় । পরে আমার মামাতো বোন আমাকে সব বলে । অবশ্য
মামা মামি আমি কষ্ট পাবো ভেবে আমকে কিছু জানান নি ।
আমরা অন্য
জায়গায় চলে আসি । আস্তে আস্তে আমি কষ্ট সহ্য করা শিখে যায় । আর তারপর থেকে পড়াশোনাতে
বেশি করে মনোযোগ দেই । আর একটা জব পেয়ে যায় । আমার লাইফটা বদলাতে শুরু করলো । আমরা
আগের মতো আবার আনন্দে আছি । মাঝে মাঝে রিতুকে খুব মিস করতাম । তাকে হাজারো রকমের চেষ্টা
করেও ভুলতে পারিনি । মাঝে মাঝে পুরানো এলাকাতে
যেতাম তাকে একবার দেখার জন্য । কিন্তু আবার চলে আসতাম মনটা খারাপ হয়ে যাবার ভয়ে ।
প্রায় দু’বছর
পর একদিন রিতুর সাথে দেখা হয় । আমার অফিসে দেখি তাকে । সে এখানে একটা জবের জন্য ইন্টারভিউ
দিতে এসেছে । আমি তাকে দেথে প্রথমে চিনতে পারছিলাম না । ভাবছিলাম না সে তো এমন ছিল
না । আজ তার মুখটা মলিন, চোখের কোনে কালো দাগ, মুখে বয়সের ছাপ , আর মনে হচ্ছে সে যেন
বয়সের ভারে ঝুকে গেছে । আসলেই সে রিতু কিনা শিওর হবার জন্য আমি তার সামনে যায় । সে
আসলেই রিতু ছিল । আমাকে দেখে তার চোখে জল আসলেও । ফাইল দিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেলে । আমিও যেন কেঁদে ফেলব সেই ভয়ে আর দাঁড়াইনি সেখানে
। আমি চলে আসতে যাচ্ছিলাম । পেছন থেকে আমকে কেউ আমার সেই পুরানো নামে ডেকে উঠল । শুভ্র
আমকে চিনতে পারোনি তাইনা । যাকে এতাদিন ধরে দেখবার জন্য উতলা ছিলাম আজ আমি চাইছিলাম না পিছু ফিরে তাকে দেখতে । কারণ
সে আমার কেউ নয় । সে শুধু আমকে কাঁদায় নি ।
আমার মা –বাবার মতো মামা- মামিকে কাঁদিয়েছে । আবার হাটতে যাবো । সে পেছন থেকে এসে আমাকে
জড়িয়ে ধরে ।
সাথে সাথে
সিকিউরিটি এসে তাকে ধরে নিয়ে যায় । আমি পারলাম না আমার মনটাকে পাষাণ সম করতে । তাই
তাকে ছেড়ে দিতে বলি । সে আমার কাছে আসে । আমিও একটু এগিয়ে যায় । তাকে দেখে আমার খুব
কষ্ট হচ্ছিল । তাকে আমার কেবিনে নিয়ে যায় । তাকে বসিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা জল দিই
। সে বলে আমকে আরো এক গ্লাস জল দেবে ? আমি নিজে এনে দিই । সে কাঁদছে । সে কেন এখানে
আর তার অবস্থা এমন কেন জানতে চাইলাম । কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না । আমিও চুপ রইলাম
।
সে নিরবতা
ভেঙে আমাকে বলল, শুভ্র তুমি ভালো আছো ? আমি হ্যাঁ
। আমাকে একটা চাকরি দিতে পারবা ? সেটা দেখব কিন্তু তোমার এমন চেহারা কেন ? রিতু
রিতিমত কাঁপছিল । তার গায়ে হাত দেবার সাহস করতে পারলাম না । তাই আমার ব্লেজারটা তাকে দিয়ে গায়ে দিতে বললাম । সে নিল কিন্তু
গায়ে দিলনা । বলল না থাক এটা নষ্ট হয়ে যাবে । আমি এটা পুরো নিয়ে যেতে চাই । আমি অবাক
হচ্ছি ?
সে যখন সব
বলতে শুরু করলো আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি । আমরা চলে আসার পর রতন দাদা আর বউদিও
অনেক কষ্ট পান । আমার মামা অন্য শাখায় ট্রান্সফার হয়ে চলে আসেন । তাই আর কোন যোগাযোগ
হয়নি তাদের সাথে । রিতু বাইক খুব ভালোবাসতো । আর রিমনের নতুন নতুন বাইকে সে প্রতিদিন
উঠত । রিমন আর তার পরিচয় একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে এভাবে তাদের সর্ম্পক অনেক গভীর হয়ে যায়
। তারা একে আপরকে ভালবাসে । আর হঠাৎ একদিন তারা বিয়ে করে নেয় । আর ভালোবাসায় এতোটা অন্ধ ছিল যে, সে কখনও রিমনের
সর্ম্পকে সব কিছু জানতেও চাইনি । বিয়ের পর প্রথম দিন রিমন তাকে নিয়ে তার বাসায় ওঠাই
। সেখানে রিতুর পক্ষে থাকা অনেক কষ্টের ছিল । তার বাসাটা ছিল শুধু ময়লা আর ঘরে অনেক
বাইক ।
পরে জানতে
পারে ছেলেটার বাইকের গ্যারেজ আছে । আর সে নানা ধরনের নেশায় আসক্ত । কিছুদিন তাদের ভালো
কাটে । তারপর থেকে শুরু হয় নানা অত্যাচার । না খেয়ে থাকতে হয়েছে । রাতে নেশা করে এসে
তাকে মারধর করতো । আর দিনের বেলাতে ঘর বাইরে থেকে দরজা দিয়ে রেখে চলে যেত । কিছু দিন
পর নতুন একটা মেয়েকে নিয়ে আসে সেখানে । আর রিতুর বুঝতে কিছু বাকি থাকে না । অবশেষে
একদিন সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসে সে । দাদা আর বউদির ওখানে যাবার মুখ নেই । তাই এক বান্ধবির
বাসায় ওঠে । আর একটা চাকরি খুঁজছে ।
আমি তাকে
ভরসা দিলাম তাকে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিব । বলতেই সে আমার হাতটা ধরে কাদতে থাকলো
। ভাগ্যিস আমি বাইকটা সে সময় কিনি নি ।
মেয়েটা
ছেলেটার বাইক দেখে প্রেমে পড়লো ।
অতপর
জানতে পারলো ।
ছেলেটা
গ্যারেজে কাজ করে ।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত : সুব্রত সরকার
Comments
Post a Comment