অসম ভালোবাসা বনাম আমাদের সমাজ
আজ বাইশে
শ্রাবণ আমার ভালোবাসার মানুষের বিয়ে । না না আমার সাথে না । আমার ভালোবাসার বিয়ে অন্য কারো সাথে । এক সম-সন্মানের অধিকারীর সাথে । এমনটা
হতো না আজ যদি আমদের সমাজ রক্ষণশীল সমাজপতিদের শৃঙ্খলা নামক শিকলে বন্দি না থাকতো ।
অসম কথাটাই
আমাদের সমাজে পত্যিােজ্যক রূপে পরিগণিত হয় । আমাদের সমাজ শিক্ষিত হচ্ছে আধিুনিক হচ্ছে
ঠিকই । কিন্তু আমরা কি পারছি আমাদের কুসংস্কার আর ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে । আজ
বিংশ শতাব্দির যুগে বসবাস করেও আমাদের মন মাসষিকতাগুলো পড়ে আছে হাজারও বছরের পুরানো
মান্ধাতা আমলে। আর অসম কথাটা তারাই ভালো বোঝে বা জানে আর ব্যাবহার করে থাকে, যারা কিনা
এ জামানার হয়েও এজামানার না । তাদের দৃষ্টিতে সব কিছুই বেমানান । ছেলে-মেয়ের সম-অধিকার
বেমানান, জাতিতে জাতিতে মিলমিশ বেমানান, ধর্মের সম্পৃক্ততা বেমানান । সমতা পান তারা
শুধু মাত্র যখন যেটা নিজের মন মতো হয় তাতেই ।
অসম বিয়ে কথাটা এই সমাজে ব্যাবহার হয়না বললেই চলে
। চলবেই বা না কেন ? যে সমাজে এখনও দশ বছরের
মেয়ের বিয়ে হয় আশি বছরের বুড়ার সাথে, যে সামজে মেয়েদের সাইকেল চালানো বা চাকরি করাটা
যেন হত্যার সম অপরাধ । সে সমাজে অসম প্রেম কথাটার কি অবস্থান তা আর বলার দরকার পড়ে
না ।
আমাদের সমাজে মেয়ে বয়সে বড় ছেলে ছোট এটা চিন্তাও
করতে লোকজন লজ্জাবোধ করে । যা কিনা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে । বাঁকা চোখে দেখা হয়
না শুধু অনেক ক্ষেত্রে এর ফলাফল ভয়াবহ রূপ নেয় আমাদের রক্ষণশীল সমাজপতিদের জন্যব ।
আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যা তিক্রম ঘটেনি ।
আমি বি.বি.এ
প্রথম বর্ষে পড়ি । এলাকার আর দশটা ছেলের মতো আমিও বেশ স্বভাবিক বেশ সাধারণ আর শান্ত
স্বভাবের একটা ছেলে। পড়াশোনা খেলাধুলা আর বাড়ির টুকটাক কাজ করে দিন কাটে আমার ।আজকাল
আমাদের এলাকাতে নতুন একটা পরিবার এসেছে । আমাদের বাড়ির একটা বাড়ি পরে । আমাদের বাড়ির
ছাদ থেকে তাদের বাড়ির ছাদ দেখা যায় । আগে ওটাই ছিল আমাদের বিকালের আড্ডার জায়গা । কিন্তু
সে আড্ডার নেশাটা কাটিয়ে উঠলেও ওই ছাদ দেখার নেশাটা যেন কিছুতেই ছাড়ছে না । এর কারণ ওই বাড়িতে একটা মেয়েও আছে । আমি যানিনা কেন জানি
তাকে দেখা আজকাল আমার নেশাতে পরিণত হয়েছে । কোন একটা সুযোগ খুজছিলাম তার সাথে একবার
কথা বলার ।
আজ রাতের
খাবার টেবিলে বাবা আমাকে সেই দেখা করার একটা ব্যটবস্থা করে দিলেন । না না শুধু দেখা
নয় প্রতিদিন তার সাথে সময় কাটানোর ব্যাবস্থা । হা তেমনই বিষয় টা । বাবা বললেন রমেশ
সাহেবের মেয়ে মিলিকে চেনো ? আমি মাথা নেড়ে না । বাবা রাগান্বিত কন্ঠে, তা চিনবা কেনো?
সারাদিন শুধু মন্টু, বল্টু, রফিক দের সাথে আড্ডা । মা বলে উঠলেন যেটা বলতে চাইছো সেটা
বলো ওকে । মার অনুরোধে বাবার গলার স্বর কিছুটা
নরম হলো । বাবা বললেন, আমিন সাহেব আমাদের একটা ফ্লাট পরে নতুন এসেছেন । ওনার মেয়ে মিলি।
বি.বি.এ ফাইনাল ইয়ারে আছে । তোমার ভার্সিটিতেই । আগামীকাল বিকাল থেকে তার কাছে পড়তে
যাবা । পড়াশোনা তো কিছুই করো না ।
আরে বাপরে
মনের ভেতর তো লাড্ডু ফাটলো । বিকালে বাবা বেশ আগে আগে অফিস থেকে এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি হতে বললেন । আমি তিন মিনিটে
তৈরি হয়ে বাবার সাথে রওনা হলাম পড়তে । বাবা দরজা নক করতেই দরজাটা খুলেদিলো মিলি দিদি
। মনে হচ্ছিল সে যেন ঘরের দরজা না তার মনের দরজাটা খুলে দিলো আমার জন্য । আমি দরজায় দাড়িয়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম । মিলি দিদি
আমাকে নাড়া দিয়ে বলল কি ভেতরে আসো । ভেতরে গেলাম ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো । আমাদের
কফি এনে হাতে দিলে কিন্তু আমি তো শুধু তাকেই দেখছি । মিলি বলল কি কফি খাওনা ? চা আনবো
নাকি জুস দিবো ? যেন আমাতে আমি ফিরে আসলাম । মিলি করেই বলি কারণ দিদি বলতে তাকে মনে
মানছিল না । আমি কিছু বলতে পারলাম না । কফিটা এক ডোকে গিলে ফেলালাম । বাবা আর মিলি
দুজনে অবাক এতো গরম কিভাবে খেলাম । কফি শেষ
করে বাবা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন ।
বাবা যেতেই
মিলি অমাকে বলল সুব্র এদিকে এসো । আমি বাচ্চা ছেলের মতো গেলাম । আমাকে তার পড়ার টেবিলে
বসিয়ে বলল তুমি কি খুব কম কথা বলো । আমি তোতলামি করে বললাম না । আসলে উত্তেজনায় ছিলাম
যে কথা বলতে পারছিলাম না । মিলি মৃদু হাসলো । যানিনা আমাকে তোতলা ভাবলো কিনা ।
এভাবে আমাদের
চলতে থাকলো । সপ্তাহে তিনদিন পড়তে যেতাম । কিন্তু সে আমাকে বলল বিকালে যদি তেমন কাজ
না থাকে তাহলে আমাদের বাসার ছাদে এসো । আমি রাজি হয়েই ছিলাম আর তার অনুরোধে কারার আগেই
বোকার মত বলে ফেলি আমার বিকালে কোন কাজ নেই । সে আবারো হাসলো । বিকালে তার পড়ানো শেষ হলে আমরা দ’জনে বসে গল্প করতাম । একদিন গল্পে গল্পে
শুনলাম আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে । সে হেসে উঠল আমি তার মুক্তার মত দাঁতের হাসি দেখে হা
হয়েছিলাম । তার কালো চোখ, কালো চুল আর মুক্তার মতো দাঁতের হাসি আমাকে এক স্বর্গ্বীয়
সুখ দেয় ।
একদমে অনেকক্ষণ
হেসে জানতে চাইল তোমার কি র্গাল ফ্রেন্ড আছে ? আমি বললাম না আর সেও বলল না । এবার দু’জনে হাসলাম । এভাবে একমাস কেটে গেল
। আমার সাথে আরও কয়েকজনকে পড়াতে শুরু করলেন । দেখতে দেখতে বারো জনের একটা ব্যা চ হয়ে
গেল । আমি প্রথম দিকে পড়া না পারলে আমাকে সে তেমন কিছু বলতো না । আজকাল বেশ বকছে ।
সেদিন রাগ করে রাগ করে আমি দু’দিন যইনি আর সিম খুলে রেখেছিলাম ।
শুক্রবার
আমি একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠি । কিন্তু আজ সকাল ৭টা বাজতেই মাথায় একটা নরম হাতের
ছোঁয়ায় লাফ দিয়ে জেগে উঠলাম । দেখি মিলি আমার বিছানায় বসা । আমি কিছু বললাম না মনে
মনে অনেক খুশি হয়েও সেটা প্রকাশ করলাম না । সে নিজে থেকেই বলল সে নাকি দু’ঘন্টা আগে এসছে।
কি হয়েছে
তোমার পড়তে যওনা ? ফোন বন্ধ? কিছুনা এক কথায় উত্তর দিয়ে বের হয়ে এলাম । সে যাবার আগে
আবার দেখা হয়ে গেল । কড়া সুরে বলে গেল আগমীকাল যেন ঠিক সময় তোমাকে আমাদের বাসায় পাই
। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না, তাই একটা চিঠি লিখে বিকালে ওনার হাতে দিয়ে চলে
এলাম । চিঠিতে সে যে আমাকে সবার সামনে বকে তাতে যে আমার অভিমান হয়, আর আমি যে তাকে
অনেক ভালোবাসি একথাগুলোোগোছালো ভাষঅয় লিখে ছিলাম। একটু পর ফোন বেঁজে উঠল । রিসিভ করতেই
ওপাশ থেকে সন্ধ্যাোয় আমার বাসার ছাদে আসো বলেই কেটে দিলো ।
ভয়েভয়ে গেলাম । আমাকে নিয়ে ছাদের কোনায় গেল অনেকক্ষণ চুপ
থাকার পর বলল দেখো সুব্র এটা আসলে ভালোবাসা না । এটা আবেগ । আমি তোমার অনেক বড় । কমকরে
হলেও তিনচার বছর । আর এটা সমাজ বিরুদ্ধ, আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি । তোমার সব কিছুই
আমার ভালো লাগে , তুমি অনেক ভদ্র আর শান্ত । আমি আর কিছু শুনতে চাচ্চিলাম না । তাই
দৌড়ে মিলিদের ছাদ থেকে সোজা সামনের কবরস্থানের দিকে চলে গেলাম । কারণ সন্ধ্যাছর পর
এদিকে তেমন কেউ আসেনা । বেশ রাত করে বাড়ি ফিরলাম । কি করে জানি বাসায় বিষয় টা জানাজানি
হয়ে গেছে আমার দিদি আমাকে কানে কানে এসে বলে গেল । পরদিন সকালে মিলির বাবা আমাদের বাসায়
আসলো আর আমার বাবার সাথে বেশ উচ্চ স্বরে কথা বলল । কি বলতে পারে আমার বুঝতে বাকি থাকলো
না । এরপর থেকে আর পড়তে যাইনি । দু’দিন
না খেয়ে ছিলাম । দরজা খুলতাম না । সারাদিন কাঁদতাম। একদিন রাতে মিলি আসলো অনেক রাতে
। আমার জানালা খোলা ছিল । আমাকে আস্তে ডেকে তুলে আমার বাড়ির ফূল বাগানে নিয়ে গেল ।
চারিদিকে শুনসান নিরবতা । হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল । আমিও কেঁদে ফেললাম । সারারাত
আমরা কথা বললাম আর কাঁদলাম । মিলি বারবার বলছে কেন তুই আমাকে ভালোবাসলি আমি যে তোর
ভালোবাসার দাম দিতে পারলাম না । আর আমিও ওতাকে এতা ভালোবেসে ফেলব ভাবতেই পারিনি ।
আজ সমাজ আর
তার অধিপতিদের জন্যর আমরা এক হতে পারলাম নারে । এভাবে কখন ভোর হলো ঠিক পাইনি । মিলি
বিদায় নিলো আবার এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো । তারপর চলে গেল ।
আজ এক সপ্তাহ
বাড়ির বাইরে যাইনা । আমার এক বন্ধু রাকিব আমার বাসায় এসে সেই অনাকাঙ্খিত কথাটা বলল
। অজানা এক কারণে মিলির আজ বিয়ে । ছেলে বিদেশ থাকে । মহল্লার সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছে শুধু তোদের বাদে
। মিলি তোকে একবার দেখা করতে অনুরোধ করেছে । আমি রাকিবকে কিছু বললাম না । ফোনটা হাতে
নিয়ে দেখি একশ নয় (১০৯) টা মিসড কল । আমি কল
দিতে যাবো তার আগেই কল আসলো । আমাদের বাড়ি আসো । আমি একটা টি-শার্ট পাল্টে চলে গেলাম
।
বাড়ি ঢুকতেই
মিলির বাবা আটকালো কিন্তু আমার কথা আর মিলির মার কথায় ছেড়ে দিলো । মিলি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে চল পালিয়ে
যাই । আমি তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বললাম তা আর হয় না । আমি তোমাদের বাড়িতে ঢোকার আগে তোমার
বাবাকে কথা দিয়েছি আমি এমন কিছু করবো না যাতে তোমার পরিবারের মান-সম্নান নষ্ট হয় ।
মিলির বিয়ে
চলছে আমি দাড়িয়ে দেখছি চোখে কোন জল নেই আমার । কিন্তু মিলির চোখে জল । বিয়ে শেষ হলো
কন্যাি বিদায় পর্ব । সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে আমাকে বলে গেল, আমার চেয়ে
ভালো মেয়ে তোর বৌ হবে । আমি ভালো মেয়ে নারে পারলে আমাকে ভুলে যাস । মিলি বলল আর যদি
কখনও তোকে মনে পড়ে আমি ডাকলে আসিস সুব্র । আমি তখনও কাঁদিনি । মিলি গাড়িতে উঠল । গাড়ি
চলে গেল । মিলির বাবা চুপ করে আমার পিছনে দাড়িয়ে আছে । আমি কেঁদে ওঠার আগেই আমার কাঁধে
হাত রেখে উনি কেঁদে উঠলেন ।
আমি কিছুক্ষণ
দাড়িয়ে থেকে বাড়ির দিকে যাচ্ছি । হাটছি আর ভাবছি সমাজ আজ আমাদের মাঝে বিশাল দেয়াল তুলে
দিয়েছে । মিলি আর আমার নয়, সে এখন অন্য কারো
কিন্তু আমার হৃদয়টা শুধুই তার ।..........................................................................
সর্বস্বত্ব
সংরক্ষিত : সুব্রত সরকার
Comments
Post a Comment