রাই বিনোদিনি
বিরোহীনি
রাই নাকি বিনোদিনী রাই । হায় হায় । রাই বিনোদিনি
আজকাল নামটা তেমন একটা ব্যবহার হয় না । আজকাল মেয়েরা বিরোহীনি রাইয়ের মত কৃষ্ণের ভালবাসা
পায় না । রাইয়ের মত অতো সুন্দরী , রুপসী, গুনবতী, মেধাবী মেয়ে আশেপাশে পাঁচ গ্রামে
আর একটাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে । শুধু কষ্টটা তার ভাগ্যে আর তার নামেও হয়তো ।
মেয়েটার মা কেন যে মেয়েটার নাম রাই রেখেছিল ? নদীর পাড় ভেঙে যেমন অন্য পাড় গড়ে, কি
জানি বিরোহীনি রাইয়ের অন্তর ভেঙে অন্য কারো অন্তর গড়ছে কিনা । জানি না নামের কারণেই তার আজ এতো কষ্ট কিনা ।
আদিত্য আজ
প্রায় পাঁচ বছর হলো রাইকে ভালবাসে । পুরো চার বছর লেগেছিল তাদের সর্ম্পকটা গড়তে । আদিত্য
যতই রাইকে বোঝাতো যে, সে রাইকে প্রাণের চেয়ে
ভালোবাসে । রাই ততো ভয় পেত । কারণ তার ভয় হতো যদি সে আদিত্যকে একবার ভালোবেসে ফেলে, আর পরে কোন কারণে সে সর্ম্পকটা নষ্ট হয় ।
তার পক্ষে আর হয়তো সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না । এটাই রাইয়ের ভয় ।
রাইয়ের মনটা
একটা আয়নার মত । তাই সে চাই না যে এটা কখনও ভেঙে চুরচুর হয়ে যাক । কারণ ভেঙে যাওয়া
আয়না হয়তো জোড়া লাগানো যেতে পারে । কিন্তু মনটা আর জোড়া দেবার মত জোর সে পাবে কিনা
। সেই একটা ভয় তাকে সব সময় তাড়া করে বেড়াই ।
মনকে বাঁধা
দিয়ে আর কতদিন রাখা যায় । নদীর বাঁধও তো একদিন ভেঙে যায় । অবশেষে আদিত্যের ভালবাসায়
সাড়া দিতেই হলো । ভালই চলছিল । রাই বড়ই সুন্দর রান্না করে আর আদিত্য বেশ ভাল খেতে পারে
। দু’জনে বেশ ভালো জমেছিল । রাই রান্না করত আর আদিত্য খেত । দু’জনকে প্রায়ই একসাথে
দেখা যেত পার্কে আরও অনেক স্থানে । অল্প অল্প অনেকেই জেনে গেল তাদের কথা ।
রাই আজকাল
বেশ পড়ছে । সামনে তার ফাইনাল ইয়ার এক্সাম । তাই আজকাল খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ করা হয়ে
ওঠে না । তবে ভালবাসায় কোন ঘাটতি ছিল না । তারা ফোনে যোগাযোগ রাখত । ছেলেটা তার বাবা-মা
আর বোনকে নিয়ে বেশ ভালই ছিল । একান সেকান হতে হতে যেদিন তার বোনের কানে তাদের সর্ম্পকের
কথাটা পৌছালো । সেদিন থেকে সমস্যার শুরু ।
বাড়িতে তার বোন তাকে নানা ভাবে বোঝাতে শুরু করে যে ঐ মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না । তার
এটা ভালো না ওটা ভালো না । এ সমস্যা সে সমস্যা । তারপরও আদিত্য মানাতে না পেরে মা-বাবা
ও চেষ্টা করলেন । না কিছুতেই কিছু যেন হচ্ছিল
না ।
আজকাল অনেক
ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েরা বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করে নেই । কিন্তু আদিত্য- রাই তেমন না ।
তারা অনেক চিন্তা ভাবনা করে এবং মা-বাবার মত
ছাড়া বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় । আমাদের সমাজে মেয়ে যেন একটা বোঝা । তা মা-বাবা
মেয়েকে যতই ভালো বাসুক না কেন । তাদের বিয়ে না দেয়া অবধি যেন তাদের শান্তি নেই । মেয়েকে
একটা ছেলের হাতে দিতে পারলেই মা-বাবা গঙ্গা স্নানের মত আত্নতৃপ্তি পান ।
আর যদি জানতে
পারেন মেয়ে কোন ছেলেকে ভালোবাসে তাহলে তো সব শেষ । মা-বাবার নাওয়া খাওয়া বন্ধ । গতকালও
যে মেয়েকে বড় ডাক্তার বানাবে ভাবছিল তাকে যেন ভ্যান চালকের সাথে হলেও বিয়ে দিয়ে দায়
এড়াতে চান । আর এটাই মা-বাবার অমতে বিয়ে করার মূল কারণ ।
তাদের কথা
শুধু আদিত্যর দিদিই জানলো না মেয়ের বাবা-মা ও জানতে পারলো । মেয়ের মা –বাবা ও কোন রকমে
রাজি হচ্ছিলেন না । আর অন্য সব বাবা-মার মত রাইকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগে গেলেন ।
আদিত্য জানলে
কষ্ট পেতে পারে তাই রাই সব গোপন করে গেল । অবশ্য এটুকু বলেছিল যে, আমাকে তুমি বিয়ে
করে নাও । নইলে আমার মা বাবা হয়তো আমাকে জোর করে কোন দিন বিয়ে দিয়ে দেবেন
। আদিত্য যেন শুনেও শোনেনি ।
। আদিত্য যেন শুনেও শোনেনি ।
যতবার রাইকে
ছেলেপক্ষ দেখতে আসে । রাই আদিত্যকে বলে কিন্তু হায় । আদিত্য যেন একটা বাক্য মুখস্থ
করে রেখেছে । আর তা হলো সময় হলে সব হবে ।
একদিন রাই
বলে আদিত্য আমি যদি সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসি । তুমি আমাকে মেনে নেবে তো । দেখ তুমিই
আমার পৃথিবী আর তুমিই আমার সব । আমি তোমকে শুধু মনটা দেইনি । আমার দেহ ,মন , প্রাণ
সবই তোমার নামে দিয়ে দিয়েছি । তুমি আমাকে গ্রহণ করো ।
আদিত্য এবার
আর চুপ থাকতে পারে না । রাইযে ব্যকুল । তাকে যে আর শিশুর মত বুঝ দিয়ে রাখা যাচ্ছিল
না । সে রাইকে জানিয়ে দেয় আমার বোন তোমাকে পছন্দ করে না । কেন করে না তা আমি জানি না
। অন্যদিকে আমার বাবা-মা তোমাকে মেনে নিতে চাইছেন না । কারন তোমাদের থেকে আমাদের জাতি
অনেক উচু । তুমি আর একটু ধৈয্য ধরো । আমি দেখছি কি করা যায় । আদিত্যের কথা যেন বশিকরণ
মন্ত্র । রাই ঠিকই সব মেনে নিয়ে সেদিন চলে গেল ।
এদিকে আদিত্য
আবার নতুন ঝামেলাই জড়িয়ে পড়লো । তার বাবা আগেই একটু অসুস্থ ছিলেন । আরও অসুস্থ হয়ে
পড়লেন । হাই ব্লাড সুগার থাকার কারণে দৃষ্টিশক্তি হারালেন । আর কোন চিকিৎসা কাজ করল
না । এদিকে সংসার আর বোনের বিয়ের চাপ পুরোটাই তার ঘাড়ে এসে পড়ল । শেষ মেষ চাকরির আসা
ছেড়ে দিয়ে তার বাবার ব্যবসাটা চালাতে লাগল । রাই মাঝে মাঝে দেখো করতো । মেলামেশা আর
চলাফেরা চলতে থাকে । কয়েক বছর পর বোনের বিয়ে দিল । ব্যবসাটাও চলছে বেশ ।
রাই মার্ষ্টাস
পড়তে ঢাকা চলে যাই । কিন্তু আদিত্য তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসতো । তার সাথে দেখা করতো
, ঘুরতো । আরও অনেক কিছু । কিন্তু বিয়ে করতে রাজি হতো না । রাইয়ের পরিবার ক্রমাগত একটার
পর একটা করে ছেলে এনে রাই কে দেখাতো । তারাপছন্দ করতো কিন্তু রাইয়ের জেদের কাছে পেরে
ওঠেনি । দিনে দিনে রাইয়ের মনে জ্বলে থাকা আশার
বাতিটা যেন এই নিভে গেল আবার এই জ্বলে উঠল অবস্থা ।
কিন্তু রাইয়ের
ব্যকুল মন আর রাইয়ের বাবা মার তাকে বিয়ের জন্য ক্রমাগত দিতে থাকা চাপে রায় মুষড়ে পড়ে
। আবার আর বারবার সে ছুটে যায় আদিত্যের কাছে । আদিত্য বলে দেখ আমি অনেক ঝামেলাই আছি
। এই মুহূর্তে আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব না । জানি না ভবিষ্যতে কি হবে । হাজারো
দিন আর রাতের জমানো স্বপ্ন যেন নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ।
রাই সেদিন
খুব কেঁদেছিল । বাথরুমের দরজা আটকে জলের কলটা ছেড়ে প্রাণ ভরে কেঁদেছিল । রাই যদি চাইতো
অনেক ভালো ছেলেকে বিয়ে করে অনেক সুখী থাকতে পারতো । কিন্তু সে তো চাইনি তার মনটা আদিত্যকে
দিয়ে দেহ নামক অসাড় বস্তু দ্বার কারো মন জয় করে তাকে ঠকাতে ।
বিধির কি
নিঠুর পরিহাস । যে কাউকে ঠকাতে চাইনা । সেই ঠকে যাই । হেরে যায় । পরাজিত হয় নিজের কাছে
। বারবার আর সেই পরাজয়ের গ্লানি টানতে টানতে একসময় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে অবশেষে হাল
ছেড়ে দেয় ।
মনের কষ্টে
সারাদিন নানা টেনশনে তার নানা মানষিক সমস্যা হতে শুরু করে । আর এদিকে রাইয়ের ছোট বোনটাও
বিয়ের বয়সী হয়ে গেছে । রাই বিয়ে না করেলে তাকেও বিয়ে দিতে পারছে না তার বাবা মা ।
রাই যাকে
এতটা ভালবাসলো সে আদিত্য তাকে তার পরিবারের ভয়ে,
তাকে বিয়ে করে আপন করে নিতে নারাজ । আজকাল রাইয়ের মনে হয় আসলেই কি আদিত্য তার
পরিবারের জন্য এমন করছে নাকি সে আর রাইকে ভালবাসে না । আদিত্যকে ভালবেসে রাইয়ের দেখা
সব স্বপ্ন গুলো যেন ধুলার চাদরে ঢাকা পড়ে দিনদিন আবছা হয়ে যাচ্ছে ।
দিন যাচ্ছে
নানা চিন্তায় তার চেহারাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে । চেহারাতে বয়সের ছাপটা যেন আজকাল বেশি
দেখা যাচ্ছে । রাই আর পারছে না । সে বারবার
চেষ্টা করেও পরাজিত । জীবন যুদ্ধে সে যেন আজ এক পরাজিত সৈনিক । তবুও সে আশায় আছে কোন
একদিন আদিত্য তাকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরবে
। আপন করে নিবে আর বিয়ে করে তাকে আদিত্যের অর্ধাঙ্গিনী করবে । তখন তার খাকবে না পরিবার
আর সমাজের ভয় ।
আজকাল আদিত্য
রাইয়ের খোজখবর আগের মতো নেই না । খুব বেশি হলে ফোন করে । সেটাও হয়তো কোন সপ্তাহে করে
কোন সপ্তাহে করে না । রাই নিজেকে ভাগ্যের হাতে শপে দিতে চাই । আর এদিকে বাবারও বয়স
হয়েছে । বাবা-মা তার দিকে তাকিয়ে আছে । কখন সে বিয়েতে রাজি হয় । সে আর বাবা- মা কে
কষ্ট দিতে চাই না । আর বোনটাকে সে যে অনেক ভালবাসে । তাই সে চাইনা বোনটা যা তা কিছু
করে ফেলুক ।
তাই সে ভাবছে আর নয় নিজেকে একটু নতুন করে আবার তৈরি
করতে হবে । আবার একটা যুদ্ধ করতে হবে । পরাজয়ের ভয় তার মনের ভেতর আর নেই । একটা চাকরি
করে নিজের পায়ে দাড়িয়ে সে দেখিয়ে দিবে ।
সে রাই কিন্তু বিনোদিনী রাই নয় । সে বিরোহীনি রাইও
নয় । সে নারী সে সব পারে । কারণ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে একমাত্র নারীই হলো সেই অপরুপ
সৃষ্টি যে সব পারে । গতকালের সব ভুলে , আজ
থেকে তার নতুন পথ চলার শুভ সূচনা হলো ।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত : সুব্রত সরকার
Comments
Post a Comment