সাঁঝের মায়া

প্রায় দু’ বছর হলো চাকরিতে ঢাকা এসেছে রাজদ্বীপ । এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে সে । চাকরিটা তার জন্য খুব দরকার ছিল । বাবার অসুখ, বোনের বিয়ে আর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে অনেক টাকার দরকার । জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে MBA পাশ করেছে রাজদ্বীপ ।

পড়াশোনা চলাকালীন তার টিউশনির টাকা দিয়ে আর বাবার আয়ের টাকায় সংসার কোনরকমে চলে যেত । বাবা সমান্য দিন মজুর । তার বাবার হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে । বাবা অনেক কষ্টে মানুষ করেছে তাদের । কিন্তু এখন বাবার বয়সের ভারে আর অসুখের কারণে সংসার চালানোই প্রায় অসম্ভব । তাই C.A পড়ার ইচ্ছাটাকে আর প্রকাশের সুযোগ নিঠুর বিধাতা তাকে দেননি ।

খুব ভালো কোন পদে না হলেও খেয়ে পরে বেঁচে আছে । সংসার চলছে ভাই বোনের পড়াশোনা আর বাবার অসুখের চিকিৎসা । রাজদ্বীপের মায়ের কথাটা বলিনি এখনও আসলে পৃথিবীর সকল মা কে সৃষ্টিকর্তা কেমন যেন অতি মানবী করে সৃষ্টি করেছেন । বাড়িতে একমাত্র মা ই আছেন যিনি রাজদ্বীপকে নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন । এত বড় শহরে কি খায়, কোথায় থাকে ।

ধার দেনা করে , মাঠের জমিজমা বন্ধক রেখে আর কিছু জমি বিক্রি করে বোনের বিয়ে দিয়েছে । বোনটা এবার অর্নাস শেষ বর্ষের ছাত্রী । বিয়ের পরও তাই বাবার বাড়ী আছে । বোনের জামাই বেশ ভালো মনের মানুষ । বেসরকারি একটা কোম্পানিতে চাকরি করছে । বেশ ভালো টাকা বেতন পায় । কথা একটু কম বলেন কিন্তু মনটা অনেক ভালো । কিন্তু বোনের শ্বশুর শাশুড়ী আর ননদ একদমী অন্য রকম ।
বিয়ের আগে কথাছিল পাঁচভরী গহনা আর দুই লাখ টাকা নগদ দিতে হবে । তারা রাজী হয়নি কিন্তু মা আর বাবা বলেন এমন ভালো ছেলে হাতছাড়া করা ঠিক না । তারা দুই ভরি গহনা আর একলাখ টাকা দিতে রাজি হই কিন্তু বরপক্ষ রাজি না । অবশেষে চার ভরি গহনা আর এক লাখ টাকাতে রাজি হয় তারা । দুই ভরি গহনা দিয়েছে ঠিকই কিন্তু নগত টাকাটা এখনও দেওয়া হয়নি । সব সময় রাজদ্বীপের মাথায় এই টাকার চিন্তায় ঘুর ঘুর করে । বেশ কিছু ধার দেনা এখনও রয়েছে বাকি ।

রাজদ্বীপের অফিসটা বাসা থেকে বেশি দূরে না । রুমের ভেতরটা বেশ গরম । তাই অফিস শেষ করেই বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় ফ্রেশ হয়ে ছাদে গিয়ে একা একা ঘোরাঘুরি করে । অবশ্য অন্য একটা কারণও বিদ্যমান । বাসার পাশের ছাদেও ঠিক ওই সময় প্রতিদিন একটা মেয়ে আসে । আর সেটা যেন সাঁঝের বেলাটাকে মায়ায় ভরিয়ে তোলে ।

কয়েকবার চোখে চোখ পড়েছে তাদের । কিন্তু কোন কথা হয়নি । সেদিন প্রচন্ড গরম পড়েছিল । সন্ধ্যা নামার আগেই তাই কেমন করে জানি হঠাৎ আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । দু’জন দুই ছাদে বৃষ্টিতে ভিজছে । কারো মুখে কথা নেই । দুজনে দুজনার দিকে তাকিয়ে আছে । কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে গেল । মেয়েটা নিচে চলে গেল না । কিছুক্ষন পর একজন মহিলা তাকে নিয়ে গেলেন । কথা শুনে মনে হলো উনি মেয়েটির মা । । রাজদ্বীপও নিচে চলে আসলো ।

পর পর তিন দিন আর সেই মেয়েটিকে দেখা যায়নি ছাদে । রাজদ্বীপ আজ কয়দিন যেন ছটফট করছিল । রাতে ভালো ঘুমও হয়নি । সে ভেবেছে । এবার দেখা হলে কথা সে বলবেই ।
চারদিনের দিন মেয়েটিকে দেখা পেল । তবে সামান্য মনমরা লাগছিল মেয়েটিকে। আজ রাজদ্বীপ তাকে বলেই ফেলল এই যে শুনছেন ? তিনবার ডাকার পর মেয়েটি সাড়া দিল । হ্যা বলুন । এই প্রথম রাজদ্বীপ আর মেয়েটি ছাদের কিনারে একসাথে এসে দাঁড়ালো । চারপাশে মৃদু বাতাস বইছে । বাতাসে বকুল আর বেলি ফুলের সুগন্ধ । সে যেন নতুন এক আবেগময় সাঁঝের মায়া ।

চারপাশে এক অন্য রকম পরিবেশ । রাজদ্বীপ শুধু মেয়েটির দিকে চেয়ে আছে । মেয়েটি বিরক্ত স্বরে বলল কিছু বলবেন ? রাজদ্বীপ না তেমন কিছু না । আপনার নামটা জানতে পারি ? হ্যা কেন নয় । আমার নাম দীপা । আপনার নাম কি ? রাজদ্বীপ তবে আপনি আমাকে দীপ বলতে পারেন । বাহ, বেশতো সত্যি কি এটা আপনার নাম ? হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি । আপনি গত তিন দিন ছাদে আসেননি যে ? মেয়েটি অবাক হয়ে বলল তার মানে আপনি আমাকে প্রতিদিন দেখেন ? রাজদ্বীপ কি বলবে ? ভাষা খুজে পাচ্ছে না । এর মধ্যেই মেয়েটিকে নিচে থেকে ডাক দিলো । আর সে আচ্ছা পরে কথা হবে বলেই ধীরে ধীরে চলে গেল ।

পরদিন আবার মেয়েটির সাথে দেখা হলো ছাদে । এভাবে কাটতে লাগল দিন, সপ্তাহ মাস । তাদের মাঝে আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল । আর সেটা আরো ঘনিষ্ঠ হতে লাগল । ঘনিষ্ট হলো সাঝেঁর মায়াটাও । তবে তারা কখনও বাইরে দেখা করে নি । কারণ হাজার অনুরোধেও মেয়েটি রাজী হয়নি । তবে তাদের প্রতিদিন দেখা হতো কথা হতো । আর সেটা ছিল দুই ছাদের কোনায় । তারা সব দিন প্রায় একই সময় দেখা করত । আর সেটা গধূলীর সময় । রাজদ্বীপ তার পরিবারের প্রায় সকল ধার দেনা পরিশোধ করে ফেলেছে । তার ভাই ও ভালো আছে । তারা সবাই এখন রাজদ্বীপের কাছে চলে এসছে । তার পরিবার এখানে একসাথে থাকে ।

এদিকে রাজদ্বীপের মা ছেলেকে বিয়ের কথা বার বার বলছে । রাজদ্বীপ কোন কথা বলে না । আর দীপার সাথে দেখা করবে বলে রাজদ্বীপ ছাদে গিয়ে একদিন খেয়াল করল । দীপার ছাদে টানানো একটা কাপড় শুকানোর দড়িতে দীপার গলাটা বেধে গেছে । কিন্তু দীপার সেটা দেখার কথা ছিল । তবুও সে খেয়াল করল না কেন ? রাজদ্বীপের একটু কেমন কেমন লাগল ।

সে দীপার কাছে জানতে চাইল । আচ্ছা তোমার ব্যাথা লাগেনিতো ? দীপা সাবলিল ভাবে বলল কেন ? ব্যাথা লাগবে কেন কি থেকে ব্যথা লাগবে ? রাজদ্বীপ চুপ থেকে বলল তুমি যে দড়িতে বেধে গেলে । দীপা কিছুটা হেঁসে বলল । এমন তো মাঝে মাঝেই হয় । বাড়িতে নতুন কিছু করা হলে বা আনা হলে আর আমি না জানতে পারলে এমন বেধে যায় । মাঝে তো একদিন পড়েই গেছিলাম । রাজদ্বীপ বলল এমন কেন ? দ্বীপা বুঝতে পেরে বলল । আমি দুঃখিত আমি তো তোমাকে বলিই নি যে আমি চোখে দেখতে পাই না ।

রাজদ্বীপের মনটা কাঁচের আয়না ভাঙার মত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল । রাজদ্বীপ বুকে সাহস নিয়ে জানতে চাইল কিভাবে এটা হলো ? মেয়েটি বলল কয়েক বছর আগে আমার প্রচন্ড জ্বর আসে । আমাকে হাসপাতোলে ভর্তি করা হয় । হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার সময় । আমাদের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে । আমার বাবা সেখানেই মারা যান । আমার মা আর আমি কোন রকম বেঁচে গেলেও আমার চোখ দুটো আর বাঁচেনি । বলতে বলতে মেয়েটির গলা যেন বন্ধ হয়ে আসছিল । কিন্তু সে থামেনি । তার চোখ দুটো ছলছল করছিল । রাজদ্বীপ কিছু না বলে এক দৌড়ে নিচে চলে যায় । সে ভাবতে থাকল, এতো দিন দেখছি তাকে । কোন দিনও বুঝতে পারিনি । সে চোখে দেখতে পারে না । আর দরজা বন্ধ করে সারাদিন ভাবে আমার কি করা উচিৎ । মাকে সব খুলে বলে । মা বলেন তুমি যদি তাকে ভালোবেসে থাকো তবে আমাদের কোন সমস্যা নেই ।

পরদিন ছাদে মেয়েটির অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকলেও আর দেখা মেলেনি । তার তিনদিন পর মেয়েটি ছাদে এসছে । কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । রাজদ্বীপ এসে বলল দীপা তুমি কোথায় ছিলে ? দীপা কেঁদে উঠল । রাজদ্বীপ বলল কাঁদছো কেন ? কি হয়েছে তোমার । দীপা বলল আমার বাবা বেঁচে থাকতে একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা হয়েছিল । গত পরশু তারা এসে বলে গেল । আমার মত অন্ধ মেয়েকে তাদের ঘরের বউ করা সম্ভব না ।

রাজদ্বীপ বলল তাতে কি হয়েছে? আচ্ছা তুমি তো আমার সব জানো । আমি কি করি আমার কে কে আছে । শুধু আমাকে দেখনি । আমাকে তোমার কেমন মনে হয় । আমি কি তোমার যোগ্য ? তুমি কি আমার ঘরের বউ হবে ?

এতক্ষন পর দীপা কথা বলল । আমাকে দেখে তোমার করুনা হচ্ছে , তাই না ? তুমি চিন্তা করবে না আমি অসহায় । আমি চোখে হয়তো দেখতে পাইনা কিন্তু আমার মনবল এখনও কমে যায়নি ।

রাজদ্বীপ আমাকে দয়াকরে ভুল বুঝবে না । আমার মা বলতেন যারা চোখে দেখতে পায়না তারা আমাদের চেয়ে বেশি দেখতে পায় । কারণ মনের চোখের চেয়ে স্পষ্ট আর কোন চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব নয় । আমাকে তুমি তোমার মনের চোখে দেখে বলনা দয়াকরে । আমি তোমার যোগ্য কি না ? আমি প্রথম দিন তোমকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি । আমি তোমাকে ছাড়া কোনকিছু চিন্তা করতে পারি না । আমি আমার মাকে তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে বলেছিলাম । কিন্তু তোমাকে বলে উঠতে পারিনি । তাই আগে থেকে তোমার মাকে জানাতে চাইনি । আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি । কোন করুনা বা দয়া নয় এটা । এটা শুধুই ভালোবাসা ।

দীপা অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে কেঁদে উঠল ।অনেক কষ্টে মেয়েটিকে রাজদ্বীপ বোঝাতে সক্ষম হলো । আর দুই পরিবার সেটা মেনে নিল । মেয়েটিকে গত পরশু রাজদ্বীপ একটা ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে । ডাক্তার বলেছে তার চোখ ভালো হবে শুধু একটা অপারেশন করাতে হবে । পাঁচ লাখ টাকা লাগবে । রাজদ্বীপ আনন্দে আটখানা । আগামী মাসে অপারেশন করাবে । আর খুব জলদি তাদের বিয়ে ।

তারা এখনও সাঝেঁর বেলায় ছাদে যায় আর এখন সাঁঝের মায়া যেন আরো তাদের বিমোহিত করে আরো কাছে ডাকে ।

এমনই ভাবে বেঁচে থাকুক প্রতিটি আশা আর ভালোবাসা ।

সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত : সুব্রত সরকার



Comments

Popular posts from this blog

বউ আমার বস

মেয়েটি ছেলেটির বাইক দেখে প্রেমে পড়ল অতপর

যাযাবর আমি