যাযাবর আমি
বসন্তের সকালে শিশির বিন্দু ভেজা ঘাসের ওপর চলতে মনের ভেতর
এক অনাবিল আনন্দ অনুভূত হয় । ব্যস্ত শহরের যান্ত্রিক জীবনে এটা এক দিবা স্বপ্ন ছাড়া
কিছুই নয় । তাইতো শহরের সকল ব্যস্ততাকে ছুটি জানিয়ে চলে এসেছি । মামার বাড়ির গ্রামে
। আমার মামার বাড়ির গ্রামটা খুবই সুন্দর । আমি ছোটবেলার অনেকটা সময় এখানে কাটিয়েছি
। তাই এখানকার প্রতি একটু বেশিই মায়া ।
গ্রামের মানুষগুলো বড়ই সহজ সরল । তারা মানুষকে ভালোবাসতে
লাভলোকসান খুজে বেড়াই না । তাদের ভালোবাসার কোন তুলনা হয় না । এক কথায় তারা মানুষ আর
আমরা যন্ত্র । তাদের আছে আবেগ অনুভুতি আর আমাদের যান্ত্রিকতা ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই
।
গ্রামের সকাল এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি । এমনই এক সকাল
গ্রামের পথে ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে আমি নদীর ধারে বসে পড়লাম । নদীর কলকল রব আর ঢেউয়ের উন্মাদনা
নিয়ে নদীর পাড়ের বুকে আছড়ে পড়া দেখতে ইচ্ছা হলো । নদীটা খুব বেশি দূরে না । তাই গিয়ে
বসলাম । আমি অবশ্য এখানে নতুন আসিনি । তবে আনেকদিন পরে এসেছি । আমার মনে আছে আমি শেষ
এখানে এসেছিলাম তের বছর আগে । তখন গ্রামটা আরো গ্রাম ছিল । আজকাল কিছুটা শহরের ভাবধারা
বইছে । আগের মানুষগুলো আরো মিশুক ছিল ।
মামারা গ্রাম ছেড়েছেন প্রায় দশবছর । এই বাড়িটা অবশ্য আমার
দাদু আমার মায়ের নামে লিখে দিয়েছেন । মামাবাড়ি আগে মাটির দেয়াল ছিল । এখন অবশ্য সেখানে
পাঁকা বাড়ি । বাড়িটা ভাড়া দেয়া আছে এটি পরিবারের কাছে । আর সেটা প্রায় আট বছর । আমাদের
জন্য একটা রুম আর রান্নাঘর ছিল আলাদা । মামারা ছুটিতে কোন কোন বছর এসে দু-তিন দিন থাকেন
। আমিও সেখানে উঠেছি । ভাড়াটিয়া লোকটা খারাপ না । গ্রামের পুরোহিত । পূজা পাঠ করে কোন
রকম সংসার চলে । বাড়িভাড়া কখনও দেন কখনও দেন না । আমরা কখনও চাইনা ।
যেহেতু আমি এখনে এসেছি এবং কিছুদিন থাকব তো রান্না করার
মন মানষিকতা আর দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলাম । প্রথমদিন সকালে ঘুম থেকে দেরিতে উঠলাম
। রান্নার সময় হয়ে উঠল না । হঠাৎ কে জানি মিষ্টি স্বরে দরজার ওপাশ থেকে বলল । এই যে
শুনছেন । আপনার কি ঘুম ভেঙেছে ? আমি উত্তর দিলাম হ্যাঁ । বলল তাহলে খেতে আসুন । আমি
বললাম আপনি কে? ভেতরে আসুন । দরজা খোলা আছে
। দরজা খুলে যেন এক পরী ঢুকলো ঘরে ।ঘরের সব জানালা তখনও খোলা হয়নি । আলো কিছুটা
কম কিন্তু তার রূপের আলোতে যেন শুধু ঘর না আমিও আলোকিত হয়ে গেছি । আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম । আর মনে হচ্ছে চারপাশে
কুমার শানুর গান বাজছে ঃ
এক লাড়কিকো দেখা তো এইছা লাগা,
য্যাইছে খিলতা গোলাপ,
য্যাইছে স্বায়েরকা খোয়াব,
য্যাইছে উজলি কিরন য্যাইছে
য্যাইছে বনমে হিরণ
য্যাইছে চাঁদনি রাত
য্যাইছে নাগমা কি বাত
য্যাইছে মন্দিরমে হো এক জলতা দিয়া ।
হঠাৎ তার হাতের স্পর্শে আমার ধা-ধা ভাঙলো । সে বলছে কি
হয়েছে আপনার শরীর খারাপ ? বাবাকে ডাকবো ? আমি থতোমতো খেয়ে বললাম না না আমি ঠিক আছি
। কে আপনি ? আমার নাম তনিমা । এটুকু কথা বলেই একটা মিষ্টি হাঁসি দিয়ে চলে গেল ।
আমি আবার যেন চারপাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনতে পারছি
ঃ
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে--
ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো ॥
এ
আমার কি হলো ? আমি কি তার মায়ায় পড়ে গেলাম । শহরে এমনটা হয়ে ওঠেনা । সবাই ব্যস্ত আর সকল কৃত্রিমতার ভিড়ে মনটাও
কৃত্রিম হয়ে যায় ।
সকালের
খাওয়াটা খেলাম তাদের সাথে কিন্তু তাকে আর দেখা গেলো না । সাহস করে রবি ঠাকুরেরে
কাছে জানতে চাইলাম তনিমা কি আপনার মেয়ে ?
উনি
মাথা নাড়লেন মনে হয় খেতে বসে তেমন কথা বলেন না । কিসে পড়ে জানতে চাইলে তনিমার মা
উত্তর দিলেন মেয়েটা এবার ইংলিশে অর্নাস শেষ করেছে । আর কিছু শনলাম না ।
নদীর
ধারে পড়ন্ত বিকালের র্সূযাস্ত দেখছি । খেয়াল করলাম তনিমাও আমার থেকে বেশ দূরে এসে
বসল । আমি তাকে ডাকতেই আমার কাছে এসে দাঁড়াল । বসতে বললাম কিন্তু বসল না । আমিও
দাঁড়াতে যাবো তখনি বিপত্তি ঘটল । আমার নতুন পরতে শেখা লুঙ্গিটা প্রায় খুলে
যাচ্ছিলো আর অনেক কষ্টে সেটা সামলানো গেল
। তনিমা তো হেঁসেই খুন । আর তার হাঁসিতে আমি খুন হয়ে যাচ্ছি ।
তনিমাকে
দেরি না করেই বলে ফেললাম আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি । তনিমা হেঁসে চলে গেল । আমি
রাত অবধি বসে রইলাম । অবশেষে তনিমার বাবা আমাকে খুঁজতে আসলেন । বললেন বাবা নদীর
ধারে কেন ? বললাম ভালো লাগছে তাই । চলো বাড়িতে যাই খাবার তৈরি হয়ে গেছে । বাড়ি
গিয়ে খাবার খেতে বসলাম । তনিমা আজ সব রান্না করেছে তার মা বলল । আমি খুব খেলাম
সবগুলো রান্নাই যেন আমার মায়ের হাতের রান্নার মত লাগছিল । খুব প্রশংসা করলাম ।
রাতে
তনিমার বাবা রবি ঠাকুরকে বললাম আঙ্কেল আপনার মেয়েকে কি বিয়ে দিবেন ? উনি বললেন কেন
বাবা ? না এমনি । উনি বুঝেতে পারলেন আমি কি বলতে চাইছি । উঠে চলে গেলেন ।
আর পরদিন সকালে মা আমাকে ফোন দিলেন । আমাকে
প্রথম প্রশ্ন, কি বলেছ রবি পুরহিতকে ? তুমি ঢাকা চলে আসো । তোমার সাথে আমার কথা
আছে । আমি কোনকিছু না বলে ঢাকা চলে গেলাম । বাসায় ঢুকতেই খাবার টেবিলে মা আমাকে
ডেকে বসালেন আর বলতে শুরু করলেন । তুমি এটা ঠিক করছ না, আমি প্রশ্ন করার সুযোগ
পেলাম না । তুমি পুরোহিতের মেয়ের ব্যাপারে যেটা ভাবছো সেটা সম্ভব নয় । তারা
ব্রাক্ষ্মণ তাদের সাথে আমদের কোনকিছু সম্ভব না । আশা করি এটুকু বোধ-বুদ্ধি তোমার
আছে । আগামী মাসে আমাদের কোম্পানিতে তাকে চাকরি দেবো আমি রবি পুরহিতকে বলেছিলাম ।
আমি চাইনা তুমি উল্টা পাল্টা কিছু কর । আমি কিছু না বলে ঘরে চলে আসলাম ।
কিছুদিন
যেতে যেতে মাস কেটে গেল । তনিমা আজ আমাদের কোম্পানির চাকরিতে যোগদান করেছে । আমাকে
দেখে সে ভীষণ খুশি । আমি চুপচাপ দঁড়িয়ে আছি, কোন কথা মুখে আসছে না ।
এভাবে
তিনটি মাস কেটে গেল দেখা হয় কিন্তু কথা হয়না । আমিও চাকরিতে মনোযোগ দিতে পারছি না
। মা রেগে গেছেন কোম্পানির লস হচ্ছে। আমি তাই আমাদের কোম্পানিটা ছেড়ে দিলাম । আজ
সারাদিন হাতির ঝিলে বসে থেকে রাতে কলাবাগান বস্তির পাশে শুয়ে রইলাম । ভাবছি তনিমা
হয়তো আসবে আমাকে খুঁজতে ।
কিছুক্ষণ
পর কিছু ছিনতাই কারি আমার সব কিছু নিয়ে গেল আমার ফোনটাও । আমাকে মেরে রাস্তার ধারে
ফেলে রেখে গেল সকালে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে ।
চোখ
মেলে দেখি তনিমা আমার বেডের পাশে কাঁদছে । আমি চোখ মেলতেই সে হেঁসে উঠল । সে নাকি
আমাকে খুঁজতে আমার বাসায় যায় । আগামী মাসে তার বিয়ে এখন যদি না আটকানো যায় তবে সব
শেষ । সে আজ প্রথম বলল সে আমাকে কত
ভালোবাসে । তার কান্নাটা থামানোর র্ব্যথ চেষ্টা করলাম । তাকে বললাম দেখ আমি তোমাকে
অনেক ভালোবাসি কিন্তু আমাদের দু’জনের পরিবার মেনে নেবে না । সে চলে যাবার আগে
আমাকে বলে গেল । যদি আমি তোমার না হতে পারি তবে আর কারও হবো না । আজই আমাকে বাবা
নিতে আসছেন । আমি চলে যাচ্ছি তবে বলে যাচ্ছি তোমার জন্য আমি আমার বিয়ের মন্ত্র
পড়ার আগ অবধি অপেক্ষা করব । কিন্তু তুমি যদি না আসো আমি আর
................................ কথাটা শেষ না করেই চলে গেল ।
আমার
সুস্থ হতে প্রায় তিনদিন লাগলো । মাকে সব খুলে বললাম । মা কিছুতেই রাজি হলেন না ।
আমি মাকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমরা একই ধর্মের তো । তমি শুধু একবার রাজি হও
বাকিটা আমি দেখে নেব । আমি তনিমার ফোনে কল
দিলাম বন্ধ । চারিদিকে যেন অন্ধকার দেখছি আমি । এভাবে আরো দশদিন কেটে গেল। এখন
আমার মা বেশ অসুস্থ । তাকে ফেলে আমি যেতে পারছি না । অবশেষে বিয়ের পাঁচদিন আগে আমি
তনিমার কাছে ছুটে গেলাম । কিন্তু তারা সেখানে নেই । কাউকে কিছু না বলে রাতের আধারে
তারা কোথায় চলে গেছে কেউ বলতে পারে না ।
আমি
পাগল হয়ে গেলাম । কোথায় যাবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না । একটা মেয়ে এসে আমাকে একটা
চিঠি দিয়ে গেল । তাতে লেখা ছিল ঃ
আমার
সুব্র ,
আমি
হয়তো আর তোমাকে পেলাম না আর তুমিও আমাকে পাবে না । আমি এখন ঘরে বন্দী আমার মা-বাবা
আমাকে তালা মেরে রেখেছে অনেক কষ্টে নুপুরের কাছে এই চিঠি পাঠালাম । আমার জন্য আর
ভেবনা । তুমি যখন এই চিঠি পড়ছ তখন আমি হয়তো পৃথিবীর মায়া ছেড়ে আর তোমাকে ছেড়ে অনেক
দূরে । আমাকে ক্ষমা করো আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না । আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি
তাই হয়তো সারাটা জীবণ অপেক্ষা করতে পারতাম কিন্তু সেটা হচ্ছে না আমার বিয়ের আগে
তুমি আসলে না । ভালো থেকো সুখে থেকো ।
তোমার
ভালোবাসা আর হতাশা নিয়ে চলে যাচ্ছি । আর আমার ভালোবাসাটা রেখে যাচ্ছি । তুমি আমার
জন্য কষ্ট পেওনা । আমি তোমার জীবনে থাকতে চাই তোমার মনটা জুড়ে । শরীরটা না থাকলেও
মনটা তোমার পৃথিবীতে তোমার কাছে রেখে গেলাম । আমি জানি তুমি আসবে কিন্তু প্লিজ
কেঁদো না । আর কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিও না ।
ইতি
তোমার
তনিমা
চিঠির
ঠিকানাতে আমি ছুটে গেলাম পথে নদী সাতরেছি, একসিডেন্ট করেছি তাও থামিনি । আবশেষে
পৌছলাম সেই ঠিকানায় । বাড়ি রঙিন কাগজে সাজানো কিন্তু কোন উৎসব নেই চারিদিকে শুধু
কান্নার রোল । অনেক লোক ভেতরে গিয়ে দেখি
আমার তনিমা মাটিতে শুয়ে আছে । মনে হচ্ছে সে যেন ঘুমিয়ে আছে । বিয়ের সাজে সাঁজানো
তাকে । তার মাথার কাছে ধুপকাঠি জলছে আর তনিমার মা-বাবা কাঁদছে । আমাকে দেখতে পেয়ে
তনিমার মা উঠে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললেন কেন তুমি এমন করলে ? আমার মেয়েটাকে
নিয়ে কেন পালিয়ে গেলে না ? তাও তো মেয়েটা আমার বেঁচে থাকতো । আজ তোমার জন্য আমার
মেয়েটা মারা গেল। তুমি আমার মেয়েকে এনে দাও ।
আমার
বলার কিছু ছিল না । কিছুক্ষণ পর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো শশ্মানে । তাকে দাহ করা হলো ।
মন চাচ্ছিলো যেন আমিও ওই চিতাতে ঝাপ দিই । করলামও তাই কিন্তু এই প্রথম তনিমার বাবা
আমাকে থামালেন । আর বললেন বাবা আমি আমার মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী, মরে তো আমার
যাওয়া উচিত । তুমি অনেক ভালো । তোমাকে আমার চিনতে ভুল হয়ে গেছে বাবা । আমাকে পারলে
ক্ষমা করো বলে পায়ে পড়ে গেল । আমি তাকে টেনে তুলতেই অঝোর ধারায় দু’জনে কাঁদলাম ।
সবাই
বাড়ি চলে গেল । আমি আর রবি পুরহিত মানে তনিমার বাবা এখনও শশ্মানে বসে আছি । এ
মৃত্যুটার জন্য আজ আমরা দু’জন দায়ী ।
আর
ফিরব না নাগরিক জীবনে । এ জীবনটাকে এভাবে
কাটিয়ে দেবো পথে প্রান্তরে। মাকে কল করে স্পষ্ট সেই কথাটা জানিয়ে দিয়ে ফোনটা নদীতে
ফেলে দিয়ে চলে এলাম ।
তাই
উঠে পড়লাম আর সন্যাসের পথে রওনা হলাম । আজ থেকে আমি যাযাবর হলাম ।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত : সুব্রত সরকার
Comments
Post a Comment